শহরের মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের কথা যদি ধরা যায় তবে দেখা যাবে চাল-ডাল, তরি-তরকারি, মাছ- গোশতসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের জন্য পরিবারটি ব্যবসায়ীদের ওপর সম্পূর্ণভাবেই নির্ভরশীল । তৈজসপত্র, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, বাচ্চাদের বই-খাতা, কলম, ব্যাগ, নাস্তা, যাতায়াত ইত্যাদি সবকিছুতেই ব্যবসায়ের সংশ্লিষ্টতা । তাই বর্তমানকালে ব্যবসায় মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষের আয় রোজগার ও সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান অবলম্বন । ব্যবসায় শুধুমাত্র একটা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সারা বিশ্বেই তার এখন অবাধ বিচরণ । তাই দেশের ভাবমূর্তি এবং সামর্থ্যও এই ব্যবসায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই ব্যবসায় কতটা নীতি-নৈতিকতা মেনে পরিচালিত হচ্ছে তার ওপর সমাজের মানুষগুলোর নৈতিকতার মান, জনগণের মন-মানসিকতা, সামাজিক সুস্থতা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইত্যাদি নানান বিষয় নির্ভর করে । যে কারণে ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমাজে অনেক বেশি প্রয়োজন । নিম্নে এর কতিপয় কারণ তুলে ধরা হলো :
১. ব্যক্তিক পরিশুদ্ধি অর্জন (Gaining individual purity): মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বিশ্বাস ও আচরণে মানুষ পরিশীলিত হবে এটাই সৃষ্টিকর্তার প্রত্যাশা । প্রতিটা মানুষও অন্যের নিকট থেকে এটাই প্রত্যাশা করে । মানুষের বিবেকবোধও তাকে সদা ভালো হয়ে চলার মন্ত্রণা দেয় । তাই একজন ব্যবসায়ী যখন লোভ-লালসা ভুলে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা মেনে ব্যবসায় করে তখন তার মধ্যে আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নির্মল মানসিক সন্তুষ্টি অর্জিত হয় ।
২. স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুরক্ষা (Careful protection of health & safety): যে কোনো সমাজেই স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। ফরমালিনযুক্ত মাছ ও ফলমুল, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদিত শাক-সবজি, খাদ্যে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রণ ইত্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভয়ংকর তা সবারই জানা । অবৈধ অস্ত্র বিক্রয় মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ । তাই ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এত্থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে ।
৩. উত্তম পরিবেশ সুরক্ষা (Careful protection of environment): মানুষ পরিবেশের দাস । উত্তম পরিবেশ মানুষকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করে । অন্যদিকে প্রতিকূল পরিবেশ মানুষকে করে বিপর্যস্ত । এই পরিবেশ বিষয়টির ওপর ব্যবসায় নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। সমগ্র বিশ্বে পরিবেশ দূষণে মুখ্য ভূমিকা রাখছে শিল্প কারখানাগুলো । তাদের নির্গত গ্যাস ও ধুয়া, নিঃসরিত বর্জ্য পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বুড়িগঙ্গার পানি, ঢাকার বাতাস সবকিছুই এর মারাত্মক শিকার । তাই নৈতিকতার শিক্ষাই ব্যবসায়ীদের পরিবেশ আইনের অনুসরণে ও উত্তম পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর সহযোগিতা দিতে পারে ।
৪. মানসিক প্রশান্তি প্রতিষ্ঠা (Establishment of mental peace): একজন মানুষ কী করছে, কী খাচ্ছে, তাকে ঠকানো হলো কি না- এগুলো নিয়ে যদি সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তায় থাকে তখন ঐ মানুষটির মানসিক প্রশান্তি থাকে না । যখন বাজারে মরা মুরগীর গোশত, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ও ক্যামিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল বিক্রয় হয়, ফরমালিনের ছড়াছড়ি থাকে, সৃষ্টিকর্মের নকল হয় অবলীলায়, নকল ও ভেজাল পণ্য কমদামে বিক্রয় হয় তখন ভোক্তা, ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউই মানসিক প্রশান্তিতে থাকতে পারে না। ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাই শুধু সে অবস্থায় মানুষের মধ্যে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারে ।
৫. সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা (Establishment of social attachment): একজন ব্যবসায়ী যখন গ্রাহককে ঠকায় তখন স্বভাবতই ঐ ব্যবসায়ীর প্রতি গ্রাহকের বিরূপ ধারণা জন্মে । একটা সমাজের অনেক ব্যবসায়ী যখন এ অন্যায় কাজটি করে তখন সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিই মানুষের বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা যদি নৈতিকতা মেনে চলে, কাউকে না ঠকায়, মিথ্যা কথা না বলে, মাপে কম না দেয়, কথা ও কাজে মিল রেখে চলে তখন গ্রাহকরা নির্দ্বিধায় ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে পারে । এতে সমাজে একটা সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।
৬. জাতীয় ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা (Establishment of national image): জাতীয় ভাবমর্যাদা যে কোনো জাতির জন্য একটা বড় সম্পদ । ভালো ব্যবসায়ীরা দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । কিন্তু ব্যবসায়ী যদি খারাপ হয়, বিদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতারণা করে তবে দেশের ভাবমূর্তি প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে । একবার বাংলাদেশের কিছু অসাধু চিংড়ি ব্যবসায়ী ওজন বাড়ানোর জন্য চিংড়ির মধ্যে লোহা ঢুকিয়ে বিদেশে বিক্রি করায় সম্ভাবনাময় চিংড়ি খাত যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা অপূরণীয় । ব্যবসায় নৈতিকতায় শুধুমাত্র এ ধরনের অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারে ।
৭. ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি অর্জন (Gaining business prosperity): ব্যবসায়ে দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জনেও মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অনুসরণ আবশ্যক । অনেক সময়ই দেখা যায়, অবৈধ ব্যবসায়ী সীমিত সময়ের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার পক্ষে ব্যবসায়ে ভালো করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র নিজেদেরই ক্ষতি করে না একটা খাতের এমনকি দেশের ব্যবসায় অগ্রগতিকেও বাধাগ্রস্ত করে । অথচ যদি দেশের ব্যবসায়ীরা সৎ হয়, নীতি-নৈতিকতার অনুসরণ করে তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তিক ও সামগ্রিক ব্যবসায়িক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয় ।
আরও দেখুন...